অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ الله عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ
أحدكم لصالته إِذا وَجَدَها – (رواه مسلم)
অনুবাদ: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ কোনো হারানো পশু পাওয়ার পর যে পরিমাণ খুশী হয়, তোমাদের তাওবার পর আল্লাহ তা’আলা এর চেয়েও অধিক খুশী হন। (মুসলিম শরীফ।
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়ার নামই তাওবা। গুনাহ্ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ও ভবিষ্যতে গুনাহের কাজ না করার সংকল্প করার নাম তাওবা।
অন্য অর্থে অনুতাপের সাথে পাপ পরিহার করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার নাম তাওবা। মুমিন জীবনের আদর্শিক গুণাবলীর অন্যতম গুণ ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর দরবারে তাওবা করা। পরম করুণাময় মহান দয়ালু আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে গুনাহ থেকে মুক্তি ও পরিত্রাণ দানের জন্য মহাগ্রন্থ আল্ ক্বোরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাওবা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন এরশাদ হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوْا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا
অর্থ: হে মুমীনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট খাটিভাবে তাওবা করো। [সূরা আত-তাহরীম: আয়াত-৮)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে-
وتُوْبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
অর্থ: হে মুমীনগণ! তোমরা সকলেই আল্লাহর কাছে তাওবা করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। [সূরা নূর: ২৪:৩১/খোদায়ী বিধান লঙ্ঘন করে স্রষ্টার আইন অমান্য করে আল্লাহর আনুগত্য না করে অবাধ্যতা প্রদর্শন করে আল্লাহর নিকট তাওবা না করা খোদাদ্রোহীতার শামিল। যারা কৃত অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আল্লাহ্র নিকট তাওবা করে অপরাধ না করার অঙ্গীকার করবে তাদের মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ كَمَنْ لا ذَنْبَ لَه – (رواه ابن ماجه – مشكوة شريف) অর্থ: গুনাহের জন্য যে ব্যক্তি তাওবা করে সে যেন এমন ব্যক্তি যার কোন প্রকার গুনাহ্ নেই।
[ইবনে মাযাহ: পৃষ্ঠা ৩১৩, মেশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ২০৬।
তাওবার উপর আল্লাহ্ তা’আলার দয়া অনুগ্রহ অফুরন্ত। প্রথমত: তাওবা দ্বারা তিনি গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। দ্বিতীয়ত: তিনি গুনাহ্ মিটিয়ে দিবেন। তৃতীয়ত: গুনাহের স্থানে নেকী দ্বারা পূর্ণ করে দিবেন।
তাওবার দরজা সর্বদা খোলা রয়েছে
বান্দা অন্যায়, অপরাধ করার পরও বান্দাকে আল্লাহ তাওবার মাধ্যমে গুনাহ্ ক্ষমা করার সুযোগ রেখেছেন। গুনাহ্ সংঘটিত হওয়া মাত্রই বান্দা যেন আল্লাহর নিকট একনিষ্ঠ খালেস বিশুদ্ধ অন্তরে তাওবা করে নেয়। কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ্ বান্দার তাওবা কবুল করার সুসংবাদ রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن أبي هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تاب قبل أن تطلع الشمس من مغربها
تاب الله عليه (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে
সুর্যোদয়ের পূর্বে (কিয়ামতের পূর্বে) তাওবা করবে তার তাওবা আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করেন। [মুসলিম শরীফ।
তাওবাতুন নাসুহা কাকে বলে?
ফারুক-ই আজম হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহ
বলেন, “তাওবাতুন নাসুহা” তথা খাটি তাওবা হচ্ছে এমন তাওবা। যে তাওবা করার পর গুনাহের দিকে ফিরে যাবে না। যেমন দুধের স্তন থেকে বের হওয়া দুধ পুনরায় ফিরে যায় না। (গুনীয়াতুত তালেবীন)
অতএব মুমীন যখনই নিজ গুনাহ্ থেকে বিশুদ্ধ চিত্তে তাওবা করবে তখন গুনাহ্ থেকে পবিত্র হয়ে যাবে। তখন তার উচিৎ গুনাহের কথা স্মরণে রেখে গুনাহের নিকটবর্তী না হওয়া। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে আল্লাহ্ তোমাদের আকৃতিকে দেখেন না বরং তোমাদের অন্তরকে দেখেন।
(١٠١)
দরসে হাদীস
* শাহেনশাহে বাগদাদ গাউসুল আজম দস্তগীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, যে ব্যক্তি গুনাহ্ করার পর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হল, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়াটা গুনাহের
কাফ্ফারা স্বরূপ।
* হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র মতে।
তাওবার চারটি স্তম্ভ:
১. মৌখিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
২. অন্তরে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।
৩. সব ধরনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুনাহ্ থেকে বিরত রাখা। ৪. ভবিষ্যতে কখনো গুনাহ্ না করার সংকল্প করা।
[গুনীয়াতুত্ তালেবীন: পৃষ্ঠা ২৫৯।
আল্লাহ্ তাওবাকারীকে পছন্দ করেন তাওবা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। এরশাদ হয়েছে-
إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ অর্থ: আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অবলম্বনকারীকে পছন্দ করেন। [সূরা বাকারা।
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)’র তাওবা সকল সম্মানিত নবীগণ ছিলেন সর্বপ্রকার সগীরা-কবীরা গুনাহ্ থেকে নিষ্পাপ ও পুতঃপবিত্র। ক্বোরআন-সুন্নাহ্, এজমা-কিয়াস ইসলামের দলীল চতুষ্টয়ের আলোকে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র গোটা জিন্দেগী ধরাধামে আবির্ভাব থেকে তিরোধান পর্যন্ত সকল প্রকার গুনাহ্ থেকে পূতঃপবিত্র হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহর দরবারে তাওবা এস্তেগফার ছিল তাঁর নিয়মিত আমল। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ الله عنه قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلُ اللَّهِ
صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وسَلَّمَ يَقُولُ والله إني لاستغفر الله واتوب اليه في اليوم أكثر من سبعين مرة ( راه البخاري) অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ্ শপথ। আমি দৈনিক সত্তরবারের অধিক তাওবা করি এবং আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। (বোখারী শরীফ: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৯৩। হাদীস শরীফে আরো বর্ণনা এসেছে-
عن ابن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا ايها الناس توبوا إلى الله فاني أتوب في
اليوم مائة مرة (رواه – مسلم) অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে মানব মন্ডলী তোম
আল্লাহর কাছে তাওবা করো। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর নিম্ন-দৈনিক একশতবার তাওবা করে থাকি।
মুসলিম শরীফ: আনোয়ারুল বয়ান। ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪
কামিল ওলীর সান্নিধ্যে গমনে তাওবা কবুল হয়ে যায় বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ে এক গুনাহগার বড় পাপী লে ছিল। যিনি একশত লোককে হত্যা করেছিল। তাওরা উদ্দেশ্যে কোন আল্লাহর ওলীর নিকট গমন করছি যাত্রাকালে পথিমধ্যে লোকটির ইন্তেকাল হয়ে গেল আযাবের ফেরেশতা ও রহমতের ফেরেশতা দুজনা লোকটির নিকট পৌছল। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দে হলো, জমিনকে পরিমাপ করা হোক। যদি তাঁর ইন্তেকা স্থান আল্লাহর ওলীর নিকটবর্তী হয় তখন তাকে জে রহমতের ফেরেশতা নিয়ে যায় এবং জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। আর যদি ইন্তেকাল স্থান মৃত ব্যক্তির ঘরের নিকটবর্ত হয় তখন আযাবের ফেরেশতা যেন তাকে নিয়ে যায় এক শান্তি প্রদান করে। জমিন পরিমাপ করা হলো, দেখা গেলে লোকটি আল্লাহর ওলীর বস্তির নিকটবর্তী, তার তাওবা করু হয়ে গেল। রহমতের ফেরেশতারা তাঁকে ক্ষমা করে দিলো।তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিলো। [মসনবী শরীফ, মুসলিম শরীফ: খণ্ড ২য়, পৃষ্ঠা ৪০৭, মিশকাত শরীষ পৃষ্ঠা ২০০
বাগদাদে কুফা নগরীতে এক গায়কের তাওবা হুযূর শাহেন শাহে বাগদাদ গাউসে আজম আবদুল কাদের
জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি বর্ণনা করেন আল্লাহর নবীর প্রিয় সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বাদগাদের কুফা শহরে এক গলি দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। দেখলেন এক ফাসিকের ঘরে অনেক মদ্য পায়ীদের সমাবেশ। সমাবেত লোকদের মধে একজন প্রসিদ্ধ গায়ক ছিল, যার নাম ‘জাদান’ সে তার সুললিত কণ্ঠে গান পরিবেশন করছিল। হযরত আবদুল্লাঃ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা তার কন্ঠের সুমধু আওয়াজ শুনে বললেন, কতই মধুর আওয়াজ! লোকটি যদি তাঁর সুললিত কণ্ঠে ক্বোরআন মজীদের তিলাওয়াত করতো কতই উত্তম হতো। তিনি চলে গেলেন। গায়ক জাদান হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদের শব্দগুলো শুনছিলেন। লোকদের জিজ্ঞেস করলেন ইনি কে? লোকেরা উত্তর দিলেন ইনি রাসূলুল্লাহর সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসা
)রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু)। জাদান জিজ্ঞেস করলেন তিনি কি বলছিলেন? লোকেরা উত্তর ছিলেন, তিনি বলছিলেন কতই উত্তম হতো যদি এ সুমধুর কন্ঠে ক্বোরআ মজীদের তিলাওয়াত করা হতো।
মুহূর্তের মধ্যে বাদ্যযন্ত্র ছুড়ে ফেলে দিলেন। দৌড়ে গিয়ে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু)’র খিদমতে হাজির হলেন, ক্রন্দন করলেন, তিনি জাদানকে জড়িয়ে ধরলেন, তার সাথে তিনি নিজেও কাঁদলেন, বললেন আল্লাহ্ যাকে ভালবাসেন আমি কেন? তাকে ভালবাসবো না। অতঃপর জাদান বাদ্য বাজনা গান বাজনা পরিত্যাগ করলেন। খাটি তাওবা করলেন, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদের সান্নিধ্য অবলম্বন করলেন। প্রচুর ইলম অর্জন করলেন। এমনকি হযরত জাদান অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ ও হযরত সালমান ফারেসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা থেকেও তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
[সূত্র: গুনীয়াতুত তালেবীন: পৃষ্ঠা ২৬২।
* বিশুদ্ধ চিত্তে তাওবা করলে গুনাহ্ সমূহ নেকীতে পরিবর্তন হয়ে যায়।
যায়।
* বিশুদ্ধ তাওবাকারীর উপর আল্লাহ্ অধিক খুশী হন।
* খাঁটি তাওবা করলে আল্লাহ্ শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া * খাঁটি অন্তরে তাওবাকারীদের ক্ষমা করা হয়, জান্নাত নসীব হয়ে যায়।
* তাওবা দ্বারা রিযক বৃদ্ধি হয় চিন্তা দূরীভূত হয়।
[মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা ২০৪)। আসুন আমরা আল্লাহর রাসূলের আদর্শ অনুসরণে আল্লাহ্-নিকট দৈনিক তাওবা ও এস্তেগফার করি। আ-মী-ন।