
সৈয়দ মোহাম্মদ শরফুদ্দীন সম্রাট
প্রারম্ভিকা: আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব,বিশালত্ব,ক্ষমতা এসব বিষয় সম্পর্কে কেয়ামত অব্দি বক্তব্য,লিখনি,আচার-অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হলে, আমাদের মত সাধারণজনের পক্ষে এর বিশ্লেষণ অনেক কঠিন ব্যাপার এবং আল্লাহ তায়ালার শান এত বিশাল যে তা কেয়ামত অব্দি আলোচনা ও বিশ্লেষণ করলে শেষ হবার নয়।
আল্লাহর মেহেরবানী ও রাসূলে পাক (ﷺ) এর উসিলায় এসব বিষয়ের মাঝে যা বোধগম্য,সেসকল অংশ যুগ যুগ ধরে আলোচিত হয়ে আসছে।আর যেসকল বিষয় আমাদের বোধদয় বা বুঝশক্তির উর্ধ্বে বা বাইরে, তা নিয়ে জ্ঞান বহির্ভূত বিশ্লেষণ ও অযাচিত আলোচনা না করাই সর্বোত্তম।
অতএব,এসব বিষয়ে আমাদের মত সাধারণজনের জন্য উত্তম হলো,হেকমত (প্রজ্ঞা) অবলম্বনকারী সালফে-সালেহীন,আউলিয়া কিরামগণ ও ঈমামগণের বক্তব্যসমূহের অনুসরণ।
এটি একটি ধর্মীয় বিশ্বাস যা বান্দার একান্ত এবং ঈমানী বিষয়।
এসব বক্তব্য ও বিষয়ের ক্ষেত্রে হাস্তিগণ,মুহাক্কিগণের অনুসরণেই সৌন্দর্য।যাতে রয়েছে উপকারিতা এবং ফজিলত।
আর দ্বিমত থাকলে,এসব বিষয়ে বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে নিরবতা অবলম্বনই উত্তম।
ঠিক একইভাবে,‘আরশের উপর সমাসীন’ বিষয়টিও আমাদের বোধগম্য বিষয় নয়।কেননা,আল্লাহর আরশে অবস্থান-এটি খুব সংবেদনশীল এবং জটিল বিষয়।কেউ যদি আল্লাহর আরশে অবস্থানকে মানুষের চেয়ারে বসা বা বসার স্থানের সাথে মিলায়!অথবা মানুষের ন্যায় আকার-আকৃতি নিয়ে বলা বুঝায়।তাহলে এটি শানে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ,বিশালত্ব,অসীমতা এর উপর বড় ধরনের গোস্তাখি ও বেয়াদবির শামিল।
সন্দেহাতীতভাবে এ ধরনের মন্তব্য করা হতে আমাদের বিরত থাকতে হবে।তাই, ثم استوى على العرش বা ‘আরশের উপর সমাসীন’ এই সাব্জেক্টিতে আমরা কোন পথে হাঁটবো বা এটিকে কিভাবে দেখবো এবং এর উপর আমাদের কিভাবে আমল করা উচিত এর একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা আমাদের মত অনভিজ্ঞ ও সাধারণজনের জন্য মুহাক্কিক হাস্তিগণ বা জ্ঞান ও হেকমায় (প্রাজ্ঞতায়) সমান পারদর্শী ওলামায়ে রাব্বানী ও ওলামায়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতগণ তৈরি করে দিয়েছেন।
সুতরাং,এই পর্বে আমরা ثم استوى على العرش বা “আরশের উপর সমাসীন” সম্পর্কে মুফাসসীর-এ-কেরাম ও সালফে-সালেহীনদের লিখনি ও বক্তব্যসমূহ হতে কিছু জানার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো।
আয়াতুল কোরআন ও এর তাফসীর :
1.قال الله تعالى: ثم استوى على العرش۔
[১] অর্থাৎ,অতঃপর (আল্লাহ তায়ালা) আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন। { সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪ }
- ثم استوى على العرش۔
[২] অর্থাৎ,অতঃপর তিনি (আল্লাহ তায়ালা) আরশে সমাসীন হলেন। { সূরা ইউনুস,আয়াত-৩ }
- الرحمن على العرش استوى۔
[৩] অর্থাৎ,দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমাসীন। { সূরা ত্বা-হা,আয়াত-৫ }
উক্ত আয়াতসমূহের তাফসীরে ➤
(১) ইমাম আবু জাফর আত-তাহাবী হানাফি (রাঃ) [ওফাত-৩২১ হিজরি] বলেন »
وقال الطحاوي ( رح) : “العرش والكرسي كما بين فى كتابه وهو مستغن عن العرش وما دونه محيط بكل شئ وفوقه۔”
❝আল্লাহ তায়ালা আরশ এবং আরশ ছাড়া যা কিছু আছে,সবকিছু হতে অমুখাপেক্ষী।তিনি আরশের উপরে-নিচে সবকিছুকে বেষ্টন করে আছেন।❞ [1]
(২) ইমাম খতিবে বাগদাদী শাফেয়ী (রাঃ) [ওফাত-৪৬৩ হিজরি] বলেন »
وقال الخطيب ( رح): “مذهب السلف إثباتها وإجراؤها على ظواهرها ونفى الكيفية والتشبيه عنها۔”
❝সালফে-সালেহীনগণ আয়াতের প্রকাশ্য অর্থের উপর মত প্রকাশ করেছেন।তবে আরশের উপর আল্লাহর সমাসীন এর সাদৃশ্য ও ধরন বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন।❞ [2]
- ব্যাখ্যা ➤ এই আলোচনা হতে আমরা শিক্ষা নিলাম যে,আরশের উপর সমাসীন এর প্রকাশ্য অর্থ অনুবাদের কারণে বা আলোচনার খাতিরে বলা যেতে পারে,কিন্তু এ বিষয়টির উপর ভিত্তি করে আল্লাহর কোনো সাদৃশ্য বা বসার ধরণ যা চেয়ারে উপবিষ্ট হওয়া বা এ জাতীয় কোনো সাদৃশ্য বা উদাহরণ দিয়ে কোন অবস্থায় বর্ণনা করা যাবে না।এক কথায় এভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে,‘আল্লাহ তাঁর শান অনুযায়ী আরশের উপর সমাসীন।’
(৩) ইমাম আল-বাগাভী শাফেয়ী (রাঃ) [ওফাত-৫১৬ হিজরি] এর মতে »
. وقال البغوي( رح): “أما اهل السنة فيقولون الاستواء على العرش صفة الله بلا كيف يجب الايمان به۔”
❝আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আলেমগণ বলেছেন যে,আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর সমাসীন,এটি তাঁর ধরণ ব্যতীত একটি গুণ।তবে,এর উপর ঈমান রাখতে হবে।❞ [3]
(৪) ইমাম নাসিরুদ্দিন বায়যাবী আশ শাফেয়ী (রাঃ) [ওফাত-৬৮৫ হিঃ] বলেন »
قال البيضاوي( رح): “معناه أن له استواء على الوجه الذى عناه منزها عن الاستقرار والتمكن۔”
❝স্থান,দৃঢ়তা,স্থিরতা ব্যতীত তিনি আরশের উপর সমাসীন।❞ [4]
(৫) ইমাম আবুল হাসান মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আব্দুর রহমান আস-সিদ্দিকী আল-বকরী (রাঃ) [ওফাত-৯৫২ হিজরি] এর মতে »
كما قال إمام أبى الحسن محمد بن محمد بن عبد الرحمن الصديقى البكرى( رح) : “والاستواء معلوم والكيف مجهول۔”
❝আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন এটি জানা আছে,তবে এর ধরণ জানা নাই।❞ [5]
(৬) আল্লামা শিহাবউদ্দিন মাহমুদ আল-আলুসী (রাঃ) [ওফাত-১২৭০ হিজরি] উল্লেখ করেছেন »
وذكر العلامة شهاب الدين السيد محمود الألوسي البغدادي( رح) : “وأنت تعلم أن طريقة كثير من العلماء الأعلام وأساطين الإسلام والإمساك عن التأويل مطلقا مع نفى التشبيه والتجسيم منهم الإمام أبو حنيفة والإمام مالك والإمام أحمد والإمام الشافعى ( رح) ۔”
❝অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম এই পন্থা অবলম্বন করতেন যে,তাঁরা আল্লাহ তায়ালার সাদৃশ্যপূর্ণ ও দেহ বিশিষ্ট হওয়াকে নাকচ করে,তার কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা থেকে বিরত থাকতেন।তাদের অন্যতম ইমাম আবু হানিফা (রাঃ),ইমাম মালেক (রাঃ),ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেয়ী (রাঃ)।❞ [6]
- ব্যাখ্যা ➤ অধিকাংশ ওলামায়ে রাব্বানী ও মুহাক্কীক আলেমগণ এর চূড়ান্ত বক্তব্য আপনাদের সামনে দৃশ্যমান যে,আল্লাহ পাক দেহ সাব্যস্ত হওয়া থেকে পাক বা মুক্ত।সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল হলো,‘চার মাযহাবের ঈমামগণ আল্লাহর দেহ সাব্যস্ত হওয়াকে নাকচ করে দিয়েছেন।’
সুতরাং,হুজ্জাত বা চূড়ান্ত দলিল হলো,আল্লাহ পাক দেহ হতে পাক এবং আরশের উপর সমাসীন হওয়া,এটি তাঁর কুদরত ও মনশা বা ইচ্ছা।
(৭) আল্লামা কাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ পানিপতি হানাফি (রাঃ) [ওফাত-১২২৫ হিজরি] বলেন »
قال الشيخ القاضى محمد ثناء الله العثماني الحنفى المظهري الپانى بتي( رح): “أجمع أهل السنة من الخلف والسلف على أن الله تعالي منزه عن صفات ألاجسام و صفات الحدوث۔”
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে,❝আল্লাহ তায়ালা দেহ ও বিনাশ হওয়া থেকে পাক বা মুক্ত।❞ [7]
(৮) ইমাম মালেক (রাঃ) এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন »
قال إمام مالك( رح): “الكيف غير معقول والاستواء منه غير مجهول ،والايمان به واجب،والسؤال عنه بدعة،وإنى أخاف ان تكون ضالا وأمر به فأخرج۔”
❝আল্লাহ তায়ালার আরশের উপর সমাসীন হওয়ার অবস্থা অজ্ঞাত।তবে,উক্ত আয়াতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব।এ সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন করা বিদয়াত।তিনি বলেন,
হে প্রশ্নকারী!তুমি পথভ্রষ্ট হওয়ার আমি আশংঙ্কা করছি।অতঃপর ইমাম মালেক তাকে বের করে দিলেন।❞ [8]
- ব্যাখ্যা ➤ ইমাম মালেক (রাঃ) মালেকী মাযহাবের ইমাম।জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুহাক্কীক।যিনি ইলমে ফিকহ এর জগতে সূর্যের সদৃশ ছিলেন।তিনি কর্তৃক প্রশ্নকারীর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন এবং প্রশ্নকারীকে নিশ্চুপ করে দেয়া,মজলিস হতে বের করে দেয়া,এটি থেকে প্রমাণিত হয় যে,আল্লাহ তায়ালার আরশের উপর সমাসীন হওয়া,তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।এর উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।তবে আরশের উপর অবস্থান এর ধরণ,দিক,এক কথায় আরশের উপর সমাসীন হওয়ার পদ্ধতি হলো,তিনি আল্লাহ,স্থিরতা ও দৃঢ়তাসহ অন্যান্য দিক যেমন-শরীর,দেহ,দেহ নিয়ে অবস্থান এর মত,এ জাতীয় সমস্ত হুদুছি বা বিনাশ হওয়া সংক্রান্ত গুণাবলি হতে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত।এটি ইমাম মালেক (রাঃ) এর চূড়ান্ত আকিদা বা বিশ্বাস।
(৯) ইমাম আবুল-লাইস সমরকন্দি (রাঃ) [ওফাত-৩৭৫ হিজরি] বলেন »
كما جاء فى تفسير السمرقندي؛ لابى الليث السمرقندي( رح): “قال بعضهم هذا من المتشابه الذى لايعلم تأويله إلا الله۔”
❝কারো কারো মতে বা কেউ কেউ বলেছেন এই আয়াতটি আয়াতে মুতাশাবিহাত বা রূপক,যার ব্যাখ্যা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কেউ জানেন না।❞ [9]
(১০) তাফসীরে মোল্লা আলী কারী হানাফীতে এভাবে উল্লেখ রয়েছে »
كما جاء فى تفسير الملا على القارى ( رح) : ” وقد قال الإمام مالك ( رح): “الاستواء معلوم والكيف مجهول والايمان به واجب والسؤال عنه بدعة”
“شرح هذا القول ملا على قاري حنفي( رح): “فالمعني أن له سبحانه استواء على العرش بالوجه الذى عناه منزها عن الاستقرار و التمكن وسائر صفات الحدوث من إثبات الجهة والجسم والحلول-“
ইমাম মালেক (রাঃ) বলেন » ❝আল্লাহ তায়ালার আরশের উপর সমাসীন হওয়ার অবস্থা অজ্ঞাত।তবে,উক্ত আয়াতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব।এ সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন করা বিদয়াত।❞
উপরিউক্ত আলোচনাটির ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম মোল্লা আলী কারী হানাফী (রাঃ) [ওফাত-১০১৪ হিজরি]⇨তিনি বলেন, ❝আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন হওয়ার পদ্ধতি হলো,তিনি স্থিরতা ও দৃঢ়তাসহ,অন্যান্য দিক (শরীর,অবস্থান) এর মত সমস্ত হুদুছি (বিনাশ হওয়া) গুণাবলি হতে মুক্ত।❞ [10]
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা জ্ঞানপিপাসুদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন এবং শিক্ষা হিসেবে পরিগণিত হবে।সাধারণজনের ক্ষেত্রে হবে উপকার।অপরদিকে,পথহারাদের জন্য হবে পথের দিশা।আবার,সংশয়কারীদের জন্য হবে সন্দেহ নিরসনের অন্যতম মাধ্যম।অর্থাৎ,এই আলোচনা ঈমানী চেতনাকে মজবুত করার এবং দুর্বল ঈমানকে সবল করার নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীব রাসূলে পাক (ﷺ) এর উসিলায় আমাদের উপকারী জ্ঞান হাসিল করার এবং এর উপর ইস্তেকামাত বা অটল থাকার তাওফিক আতা করুন।
সূত্র-
[1] তাফসীরে মাযহারী⇨৩য় খন্ড,সূরা ইউনুস,আয়াত-৩,পৃষ্ঠা-৩৯৮।
[2] তাফসীরে মাযহারী⇨৩য় খন্ড,সূরা ইউনুস,আয়াত-৩,পৃষ্ঠা-৩৯৮।
[3] তাফসীরে মাযহারী⇨৩য় খন্ড,সূরা ইউনুস,আয়াত-৩,পৃষ্ঠা-৩৯৮।
[4] তাফসীরে মাযহারী⇨৩য় খন্ড,সূরা ইউনুস,আয়াত-৩,পৃষ্ঠা-৩৯৮।
[5] তাফসীরে বকরী⇨১ম খন্ড,সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪,পৃষ্ঠা⇨৪১৫।
[6] তাফসীরে রুহুল মা’য়ানী⇨৮ম খন্ড,সূরা ত্বাহা,আয়াত-৫,পৃষ্ঠা-৪৭২।
[7] তাফসীরে মাযহারী⇨৩য় খন্ড,সূরা ইউনুস,আয়াত-৩,পৃষ্ঠা-৩৯৭।
[8] তাফসীরে দুররুল মানসুর⇨৩য় খন্ড,সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪,পৃষ্ঠা-১৭০ এবং তাফসীরে মোল্লা আলী কারী হানাফী (রাঃ)⇨২য় খন্ড,সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪,পৃষ্ঠা-১৩৫।
[9] তাফসীরে সামারকান্দী⇨১ম খন্ড,সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪,পৃষ্ঠা-৫৪৫।
[10] তাফসীরে মোল্লা আলী কারী হানাফী⇨২য় খন্ড,সূরা আরাফ,আয়াত-৫৪,পৃষ্ঠা-১৩৫।