মানব জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বিষয়

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عن عمرو بن ميمون أن النبي صلى الله عليه وسلم قال الرجل اغتتم خمسا قبل خمس حياتك قبل موتك وفراغك قبل شغلك وغناك قبل فترك وشبابك قبل هرمك وصحتك قبل سقمك، (مصنف بن ابي شيبه

ج – ٧ – حديث – ٣٤٣١٩)

অনুবাদ। হযরত আমর ইবনে মায়মুন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে (উপদেশ দিতে গিয়ে) বলেছেন, তুমি পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগে গুরুত্ব দেবে। এক মৃতা আসার আগে জীবনকে, দুই, ব্যস্ততার আগে তোমার অবসর সময়কে, তিন, দারিদ্রতা আসার পূর্বে তোমার স্বচ্ছলতাকে, চার, বার্ধক্য এসে যাওয়ার আগে তোমার যৌবনকালকে, পাঁচ, অসুস্থতা এসে যাওয়ার আগে সুস্থতাকে।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

বর্ণিত হাদীস শরীফে রাসূলে পাক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত উপদেশ নামায় মানব জাতির একটি আদর্শ জীবন উন্নত সুস্থ ও সফল জীবন গঠনের রূপরেখা উপস্থাপিত হয়েছে। নবীজির নির্দেশিত প্রতিটি নির্দেশনা বাস্তব ভিত্তিক, বিজ্ঞান সম্মত এর আবেদন সুদূর প্রসারী ও তাৎপর্যবহ।

এক. জীবন-মৃত্যু

জীবন মহান আল্লাহর এক শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত। এ জীবন আমাদের জন্য ক্ষণস্থায়ী, আমরা ছিলাম না, করুণাময় প্রভু

অনস্তিত্ব থেকে আমাদের অস্তিত্ব দান করেছেন। এ জীবনে আমাদের অবস্থান ও মেয়াদকালের সময়সীমা তাঁরই কর্তৃক নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত। সুনির্দিষ্ট সময়ে তাঁরই আহবানে সাড়া দিতে হবে। তাঁর নিকট উপস্থিত হতে হবে। এ জীবনে অর্জিত কৃতকর্মের প্রতিটি বিষয়ে তারই আদালতে জবাবদিহি করতে হবে। মৃত্যু আমাদের জন্য অনিবার্য। প্রত্যেক আত্মাই মরণশীল। এ মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকার, পালাবার বা দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। যেখানে যে অবস্থায় পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে আমরা থাকিনা কেন। মৃত্যুর মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকাল সুখময় চিরস্থায়ী জান্নাতের নিয়ামত রাজি উপভোগের ঘোষণাও রয়েছে। আমরা যদি মহান আল্লাহর নির্দেশিত প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত মহান সাহাবায়ে কেরাম ও
সালেহীন আউলিয়ায়ে কেরামের অনুসৃত পথে পরিচালিত করে নিজেদের ইহকালীন জীবনকে কোরআন সুন্নাহ’র রঙে রঞ্জিত করতে পারি দ্বীনি আখলাক, নৈতিকতা ও আদর্শ চরিত্রে নিজেকে পরিবারকে আলোকিত করতে পারি আমাদের পরকাল হবে সুখময় চিরস্থায়ী শান্তির নীড়। মৃত্যু অবধারিত সত্য। মৃত্য নামক এ চির সত্য বিষয়টি কে কোন মুহূর্তে হাজির হতে পারে। জন্মের ক্ষেত্রে দাদার পর বাবা এসেছেন। ইন্তেকালে ধারাবাহিকতা নেই। দেখা যায় বাবার আগে ছেলের মৃত্যু হয়েছে, দাদার আগে বাবার মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহর কুদরতে নাস্তার একজন আরবি কবির পংক্তিতে এসেছে-

موت كأس كل ناس شاربوا – قبر بيت كل ناس داخلوا অর্থাৎ মৃত্যু পাত্রের স্বাদ প্রত্যেক মানুষকেই আস্বাদন করতে হবে। আর কবর হলো এমন বাড়ি যে বাড়িতে প্রত্যেক মানুষকেই প্রবেশ করতে হবে।

দুই, অবসর ও ব্যস্ততা

অবসর ও ব্যস্ততা দুটোই আল্লাহর নিয়ন্ত্রিত, ব্যস্ততা এ অর্থে নিয়ামত যে একজন মুসলিম হিসেবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কর্মব্যস্ত সময় অতিবাহিত করা এটা জীবনের সফলতা। ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক জনসেবা সমাজ সেবা ও দ্বীনি দাওয়াতী কর্মকান্ড, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দ্বীনিয়া শিক্ষাদানে নিয়োজিত থাকা আদর্শ রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনে সক্রিয় ও সচেষ্ট থেকে ব্যস্ততার মাঝে সময় অতিবাহিত করা, পরম সৌভাগ্যের ও কল্যাণের। অবসর এ অর্থে নিয়ামত যে, অবসর সময়ে ইচ্ছে করলে অনেক ভালো কাজে মনোনিবেশ করলে মানুষ নিজেও উপকৃত হতে পারে। চাইলে এ সময়ে পরিবার পরিজন ছেলে সন্তানের জন্য অনেক ভালো কাজ আঞ্জাম দিয়ে তাদেরও কল্যাণ সাধন

করতে পারে। হাদীসের শিক্ষা: ব্যস্ততা এসে যাওয়ার আগে অবসর

সময়কে কাজে লাগাও। অনেকেই আছেন আজকের এই অবসর সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করার সুযোগ এক রয়েছে। অবহেলা অলসতা বশত কাজটি আগামীকাল বা এর পরবর্তী সময়ে করার ইচ্ছায় তা সম্পাদনে বিরত থাকে, দেখা যায় আগামীকাল বা পরবর্তী সময়ে এর চেয়েও • আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাজির হয়ে পড়েছে যা ত করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, এমতাবস্থায় অবসর সময়ে না করা কাজটি করার সুযোগই মিলছে না। এতে ক্ষতির * সম্মুখীন হতে হলো এ অবহেলাটা শাস্তি, অসম্মান বা রি আর্থিক ক্ষতির কারণও হতে পারে। হাদীস শরীফে এরশাদ

হয়েছে-عن ابن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم نعمتان مغبون فيهما كثير . من الناس . الصحة والفراغ

অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে – বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, দুটো নিয়ামত আছে যেগুলোতে অনেক মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়। একটি হলো সুস্থতা অপরটি হলো অবসর।

[আল মুস্তাদারাক আলাআস্সাহীহাইন খ-৪, পৃষ্ঠা ৩৪১, হাদীস

৭৮৪৫) মানব জীবনের স্বাভাবিক প্রবণতা বর্ণিত হাদীসে আলোকপাত হয়েছে। এ দুটো সুযোগ সময়কে মানুষ অবহেলায় কাটিয়ে দেয়। এখনো সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হইনি আরেকটু সুস্থ হলে বা আরেকটু অবসর হলে কাজটি সম্পাদন করবো। ফলে দেখা যায় আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অথবা ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেছে- যে কারণে কাজটি করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এ কারণে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ নিয়ামত দুটিকে গণিমত মনে করার নির্দেশ দিয়েছেন।

তিন, দারিদ্রতা ও স্বচ্ছলতা

মানুষ আগামীকাল সম্পর্কে জানে না, তার ভবিষ্যৎ উন্নতি অবনতি, সফলতা, ব্যর্থতা, স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলাতা সম্পর্কে অবগত নয়। মানুষের স্বপ্ন অপরিসীম, চাহিদা প্রচুর, যোগান সীমিত, কল্পনার সীমা নেই। বর্তমানে নিজের নাগালে প্রয়োজনীয় যে অর্থ সম্পদ আছে ওই সম্পদ আর্থিক প্রাচুর্যতা ও স্বচ্ছলতাকে স্থায়ী মনে করা যাবে না, ভবিষ্যতে এ সম্পদ যে কোন কারণে বা উপায়ে হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই ভবিষ্যতের অপেক্ষায় না থেকে স্বচ্ছলতা অবস্থায় দান-সাদকা, যাকাত-ফিতরা আদায়, দ্বীনি কর্মকান্ডে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা সহযোগিতা ইত্যাদি মহৎ কর্মে দানশীলতা ও বদান্যতা বজায় রাখা মুমিনের পরিচায়ক। আর্থিক সামর্থবান হওয়া মাত্র বিলম্ব না করে হজ্বব্রত পালন করা উচিত। আরো কয়েক বৎসর পরে করব বিভিন্ন অজুহাতে কালক্ষেপণ করা উচিত নয়। আগামী বৎসর স্বচ্ছলতা বা আর্থিক সক্ষমতা নাও থাকতে পারে।

মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন-

وانفقوا من ما رزقناكم من قبل ان ياتي احدكم الموت فيقول رب لولا اخرتني الى اجل قريب فاصدق واكن من الصالحين ولن يوخر الله نفسا اذا جاء أجلها والله خبير بما تعملون

র্থ: আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যু আসার আগেই তা থেকে তোমরা ব্যয় করো, মৃত্যুর সময় সে বলে হে আমার প্রভুঃ আমাকে কেন আরেকটু সময় দিলে না? তাহলে আমি দান করতাম ও নেক্কার লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। অথচ যখন কারো সময় পূর্ণ হয়ে যায় তখন আল্লাহ্ কোন লোককে সময় দেন না- আর তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ্ তা সম্পর্কে সম্যক
অবগত। আল কোরআন: ৬৩ আয়াত-১০-১১)

চার. বার্ধক্য ও যৌবনকাল

যৌবনকাল বিদায় নিলে পুনরায় তা ফিরে আসবে না।

বার্ধক্য আসার পূর্বেই যৌবনকালকে গণিতম মনে করতে হবে, যৌবনকাল মহান আল্লাহর এক বড় নিয়ামত, যৌবনকালের প্রতিটি মুহূর্ত যারা যথাযথভাবে সঠিক পথে অতিবাহিত করেছে তারা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। ইসলামে যৌবন কালের ইবাদতকে উত্তম ইবাদতরূপে সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের মহামনীষী সাহাবায়ে কেরাম তাবেঈন, তবেতাবেঈন
আল্লাহর পথে উৎসর্গ ত নিজেদের জীবন বৌ অর্জনগুলো হাসিলের জন্য যৌবনকালকে তারা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

হাদীস শরীফে সাত শ্রেণির বান্দারা কিয়ামতের দিবসে আল্লাহর আরশেরাজ তেনির বান্দারা কিয়ামতের দিবসে এসেছে। তন্মধ্যে দ্বিতীয় মর্যাদায় রয়েছে যুবক। এরশাদ وشاب نشأ في عبادة اللর্থাৎ ইবাদতের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা যুবক। ২। বর্জোয় অল্লোহর ইবাদহিক সক্ষমতা শক্তি সামর্থ সব হারিয়ে ফেলে। ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, চিন্তা চেতনায় কর্মপ্রচেষ্টা সবকিছু নিস্তেজ হয়ে যায়। এ কারণেই বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকালকে নিজের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোর প্রাপ্তির জন্য উত্তম সময় হিসেবে এ সময়কে গণিমত মনে করার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যৌবনের শক্তি সামর্থ যারা দ্বীনের পথে সুন্নীয়তের পথে ব্যয় করবে তারাই সফল ও সার্থক। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-

عن معاذ بن جبل رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تزول قدما عبد يوم القيامة حتى يسأل عن أربع خصال عن عمره فيما أفناه وعن شبابه فيما ابلاء وعن ماله من اين اكتسبه وفيما انفقه، وعن علمه )ماذا عمل فيه (المعجم الكبير

অর্থ: হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি

ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হয়ে কিয়ামতের দিন বান্দার দুই পা অগ্রসর হতে পারবে না। তার বয়স-কিভাবে অতিবাহিত করেছে, যৌবন সম্পর্কে- কোন কাজে তা ক্ষয় করেছে? সম্পদ সম্পর্কে কিভাবে তা অর্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে। ইলম সম্পর্কে ইলম অনুযায়ী সে কী আমল। করেছে?

পাঁচ, সুস্থতা-অসুস্থতা

সুস্থতা আল্লাহর এক মহান নিয়ামত। শারীরিক সুস্থতা ছাড়া ধর্ম কর্ম তথা ইবাদত বন্দেগী পারিবারিক সামাজিক ধর্মীয় কোন প্রকার কর্মকান্ডে একাগ্রতা, নিষ্ঠা, মনোযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। অসুস্থতা নিয়ে ইচ্ছা থাকলেও কোন কাজের যথাযথ সফলতা পাওয়া যায় না। যেকোন সময়ে অসুস্থ হতে পারে। যতদিন দৈহিকভাবে সুস্থতা বিরাজ করে ততদিন কোন কাজে দায়িত্ব পালনে, কর্তব্য সম্পাদনে অবহেলা বা অলসতা করে সময় অপচয় করে কাজ থেকে বিরত থাকা, বিমুখ হওয়া সমীচিন নয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় দ্বীনি দুনিয়াবী কল্যাণকর যে কোন কাজকে তুলনায় আরো অবনতি হতে পারে। তাই ভালো কর্মে মহৎ কাজে কালক্ষেপণ বা বিলম্ব করা উচিত নয়। আল্লাহ আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *