ইসলামে মিসওয়াকের গুরুত্ব

মাওলানা অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবু তৈয়ব

‘মিসওয়াক’ এর শাব্দিক অর্থ দাঁত ঘষামাজা করা, দাঁত পরিষ্কার করা। শরীয়তের পরিভাষায়- দাঁতের ময়লা পরিষ্কার করার জন্য দাঁতে গাছের ডাল বা এ জাতীয় অন্য যা কিছু ব্যবহার করা হয়, তাকে মিসওয়াক বলে। মিসওয়াক করা সুন্নাত। এর ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- মিসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম ও আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উপায়।

[নাসায়ী, বুখারী ও মিশকাত: পৃষ্ঠা ৪৪)

উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ‘মিসওয়াক’ করে যে নামায আদায় করা হয় সে নামায ঐ নামাযের তুলনায় সত্তর গুণ বেশী ফজিলতপূর্ণ যা মিসওয়াক ছাড়া আদায় করা হয়।

[বায়হাকী ও মিশকাত: পৃষ্ঠা ৪৫।

হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ১০টি জিনিস ফিতরাতের অন্ত র্ভুক্ত। ১. কুলি করা, ২. নাকে পানি দেওয়া, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. গোঁফ কাটা, ৫. নখ কাটা, ৬. বগলের পশম উপড়ে ফেলা, ৭. নাভীর নীচের পশম মুণ্ডানো, ৮. আঙ্গুলের গিরা সমূহ ধোয়া, ৯. ইসতিন্‌ন্জায় পানি ব্যবহার করা, ১০. খৎনা করা। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৫৩)

অন্যত্র হযরত মালীহ ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসূলে আকরাম, নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-পাঁচটি কাজ নবী রাসূলদের সুন্নাত। যথা- লজ্জা, সহনশীলতা, শিঙ্গা লাগানো, মিসওয়াক করা, আতর বা সুগন্ধী ব্যবহার করা।

হযরত আবু আইউব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, চারটি কাজ রাসূলগণের সুন্নত। খৎনা করা, সুগন্ধী ব্যবহার করা, মিসওয়াক করা ও বিবাহ করা। [জামে তিরমিযী, হাদীস: ১১০১

উপরিউক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা সুস্পষ্ট হল, মিসওয়াককারী মিসওয়াকের অন্যান্য উপকারিতার পাশাপাশি নবীগণের সুন্নত পালনের সাওয়াবও পেয়ে থাকে। জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে, মিসওয়াক করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ইমাম

মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী

শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মতে মিসওয়াক নামাযের সুন্নাত। তবে ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে মিসওয়াক হলো ওযুর সুন্নাত। মিসওয়াক ব্যাধি ও জীবাণু বিনাশক। মিসওয়াক হলো দুর্গন্ধ প্রতিরোধক। যখনই মিসওয়াক ব্যবহার করা হয় তখনই তা মুখের অভ্যন্তরীন জীবাণু ধ্বংস করতে থাকে ফলে নামাযীরা অনেক রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পায় এমনকি কোন কোন জীবাণু শুধু মিসওয়াকে বিদ্যমান প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রভাবে বিনাশ হয়ে থাকে।

যা দ্বারা মিসওয়াক করতে হবে

যায়তুন গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা উত্তম। এটা

বরকতময় গাছের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এটা মুখকে করে সুগন্ধময় এবং পিত্তও দূর করে। নবীগণ তা দ্বারা মিসওয়াক করতেন। মিসওয়াক যেন শক্ত বা নরম না হয়। মিসওয়াক পাওয়া না গেলে হাতের আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করতে হবে। তিক্ত গাছের ডালি তথা নিম গাছের ডালি দ্বারাও মিসওয়াক করা উত্তম। পীলু বা বাবলা গাছের দ্বারা মিসওয়াক করা যাবে।

যা দিয়ে মিসওয়াক নিষিদ্ধ

যা দ্বারা দাঁতের ক্ষতির আশংকা থাকে। যেমন বাঁশের কঞ্চি, ডালিম এবং চামেলী ফুলের ডাল। বিষাক্ত গাছের ডাল, রায়হান ফুলের কাষ্ঠ এবং অন্যান্য অজানা বৃক্ষ দ্বারা মিসওয়াক নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তারেক মাহমুদ বলেন, জনৈক রোগী মুখের দুর্গন্ধের জন্য উন্নত মানের সব টুথপেস্ট, ওষুধ, মাজন এবং দুর্গন্ধ বিনাশী ওষুধপত্র ব্যবহার করেছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। অতঃপর এ বিষয়ে পরামর্শ চাওয়ার পর আমি তাকে পিলু মিসওয়াক ব্যবহারের পরামর্শ দিলাম। তাকে আরো সতর্ক করে দিলাম প্রতিদিন যেন মিসওয়াকের আঁশগুলো (পুরাতন আঁশগুলো ছেটে) নবায়িত করা হয়। অন্যথা মিসওয়াক ব্যব্যহারে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। ওই রোগী এভাবে কিছু দিন মিসওয়াক করার পর তার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

মিসওয়াকের সুন্নাত পদ্ধতি

মিসওয়াক করার সময় এ দু’আ পড়া উত্তম-اللَّهُمَّ طَهِّرْ فَمِنْ وَنُورٌ قَلْبِي وَطَهِّرْ بَدَنِي حَرَّمٌ جَسَدِي عَلَى النَّارِ

ওহে আল্লার। তুমি আমার মুখ পবিত্র কর, আমার অভর আমার শরীর পাক কর এবং আগুনের জন্য আমার শরীর হারাম কর।
প্রথমে মুখের ডান দিকে উপরের পাটি এবার, এরপর বাম শাপের শীতের উপরে পারি রানার নীচের পাটি ওথার হয়ে মিসওয়াক করতে হবে। খাড়াখাড়ি নয়, বরং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আড়া-অনুিতার মিসওয়াক করতেন, তবে জিহ্বা পরিষ্কার করতে হলে খাড়াখাড়ি করতেন। (মুসনাদে আহমদ)

মিসওয়াকের আকার

মিসওয়াক বেশী মোটা কিংবা একেবারে সরুও যেন না হয়। কনিষ্ট আঙ্গুলের মত মোটা এবং দৈর্ঘ এক বিঘত

হতে হবে। বাহরুর রায়েক।

নিম্নোক্ত সময়ে মিসওয়াক করা সুন্নাত

ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মতে ওযুর সময় মিসওয়াক করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মতে নামাযের সময় মিসওয়াক

করা সুন্নাত। ওযুর শুরুতে কুলি করার সময়। ঘুমানোর আগে (মাজমা ও কাশফুল গুম্মাহ)। ঘুম থেকে জাগ্রত হলে (বুখারী, মুসলিম আবু দাউদ)। শেষ রাতে মিসওয়াক করে নামায আদায় করা (বুখারী শরীফ)। কোরআন তেলাওয়াতের পূর্বে (ইবনে মাজাহ)। ঘরে প্রবেশ করার পর (মুসলিম)। সফরকালে (তারগীব)। জুমার দিন (মুয়াত্তা, তাহাবী শরীফ)। কোন মজলিসে যাওয়ার পূর্বে (তারগীব)। সাহারী খাওয়ার পূর্বে। রোজা অবস্থায়, ইহরাম অবস্থায় (মাজমা, ইবনে মাজাহ)। বায়তুল্লাহ্ শরীফে প্রবেশের পূর্বে (তারগীব)। মৃত্যুর আগে (বুখারী শরীফ)। স্ত্রী সহবাসের পূর্বে (তারগীব)।

মিসওয়াকের বর্জনীয় বিষয়াবলী

চিৎ হয়ে শুয়ে মিসওয়াক করা। মিসওয়াক মাটিতে ফেলে

রাখা। এতে পাগল হওয়ার আশংকা থাকে (রদ্দুল মুখতার)। টয়লেটে মিসওয়াক করা। কুলুখ নিয়ে হাঁটা অবস্থায় মিসওয়াক করা। হেঁটে হেঁটে মিসওয়াক করা। মিসওয়াক দু’পাশ ব্যহার করা। মসজিদে মিসওয়াক করা ইত্যাদি।

মিসওয়াক ও ব্রাশের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণের দীর্ঘ দিনের গবেষণার পর তাঁরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, একবার ব্যবহার করা ব্রাশ দ্বিতীয়বার ব্যবহার করলে ক্ষতির আশংকা থাকে। কেননা

১বার ব্যবহার দ্বারা এর মধ্যে জীবাণর ভিত্তি স্থাপিত হয় যায়। পানি দ্বারা পরিষ্কার করলেও তা দূরীভূত হয় না তাছাড়াও ব্রাশ দাঁতের উপরের উজ্জলতাকে নষ্ট কর দেয় এর ফলে দাঁতের মধ্যে ফাঁক সষ্টি হয় এবং ধীরে ধীদে দাঁতগুলো মাড়ী থেকে আলাদা হয়ে যায়।

বিন্নাতে রাসুল ও আধুনিক বিজ্ঞান। ড. মুহাম্মদ তারেক মাহমুদ ১ম খ মুতাআখৰিতীন ওলামায়ে কেরামগণের মতে, ব্রাশ বা অ কোন আধুনিক উপকরণ দ্বারা মিসওয়াক করলে সুন্নাহ আদায় হবে, তবে সেগুলো (ব্রাশ বা আধুনিক উপকরণটি হালাল বস্তুর হতে হবে। যেমন- ব্রাশের পশম যদি শুকরের লোম হয় বা অন্য কোন নাপাক বস্তু দ্বারা তৈরি হয় তাহলে

সে ব্রাশ দ্বারা মিসওয়াক করা হারাম।

মিসওয়াকের উপকারিতা

হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নই দোজাহান সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, মিসওয়াক সহকারে নামায পড়ার ফজিলত

মিসওয়াক বিহীন নামাযের উপর সত্তর গুণ বেশী।

[মেশকাত শরীফ

হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, মিসওয়াক মৃত্যু ছাড়া সকল রোগের ওষুধ স্বরূপ।

[দায়লামী শরীফ।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মিসওয়াক মানুষের হৃদয়গ্রাহী (সুস্পষ্ট ও অলংকার সম্মত) বক্তব্য রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কফ দূরীভূত করে।

[মারাকিযুল ফালাহ।

হযরত আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মিসওয়াক অপরিহার্য করে নাও তাতে আলস্য করোনা। কেননা মিসওয়াকে ২৪টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- আল্লাহ্ তা’আলা সন্তুষ্ট হন, আর্থিক প্রাচুর্য লাভ হয়, মুখে সুগন্ধী সৃষ্টি হয়, দাঁতের মাড়ি মজবুত হয়, মাথাব্যাথা দূর হয়ে শান্তি অর্জিত হয়, গালের চিবুক দু’টির ব্যাথা দূর হয় এবং চেহারার নূর ও দাঁতের চমকের কারণে ফিরিশতা করমর্দন করেন। (কোশাইরীী)

মিসওয়াকের আরো বহু উপকারিতা রয়েছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত ব্যতীত কোন মুসলমানের তার আমলী জিন্দেগী সুন্দরভাবে গঠন করা অসম্ভব। তাই রাসূলের আশেক ও খাঁটি উম্মত হওয়ার লক্ষ্যে মিসওয়াকসহ প্রতিটি সুন্নাত ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে তা স্বীয় জীবনে যথাযথভাবে

বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে এ তৌফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *