“ইসলামে মাতৃভাষার মূল্যায়ন”।

‘মুহাম্মদ আবদুল কাদের ছাকিব আল কাদেরী’

ভাষা। মানবজাতির অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ভূপৃষ্ঠে বসবাসরত মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি হাজারো সৃষ্টির মাঝে মানুষকে স্বকীয়তা দান করেছে এবং মর্যাদাবান বানিয়েছে কথা বলার শক্তি বা ‘ভাষা’। মানুষ কে বলা হয় حيوان ناطق

ভাষা মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। হৃদ এবং মস্তিষ্কে ঘোরতে থাকা বিশ্বাস,চিন্তা এবং মতবাদ কে আশপাশের মানুষের কাছে উপস্থাপনের দুয়ার। মাতৃভাষা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া অতুল, অনুপম এক নি’মাত। মহান খোদা তায়ালা ইরশাদ ফরমান : خلق الانسان-علمه البيان

অর্থাৎ- তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন বার্তালাপ। (1)

পৃথিবীতে বসবাসরত মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় ৭৩৩০ টি ভাষা ভূপৃষ্ঠে অস্তিত্বে ছিলো।২০১৯ ঈসায়ী সনের হিসাব অনুযায়ী জীবিত ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯ টি(2)। একটি পরিপূর্ণ, আদর্শ এবং একমাত্র গ্রহনযোগ্য জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। বলা চলে, ইসলাম ধর্ম হিসেবে যেমন অতুলনীয়, তেমনি মাতৃভাষার প্রতি তাঁর মূল্যায়ন ও অতুলনীয়। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, কুল কায়েনাতের রাসুল,আমাদের নবী ‘হযরত মুহাম্মদ (দরূদ)’ ভাষাগত স্বাধীনতা কে মর্যাদাবান করেছেন। ইসলাম মাতৃভাষার মূল্যায়ন এবং গুরুত্ব কে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আসুন! একনজরে দেখে আসি এই মূল্যায়নের দৃশ্যপট।

★ভাষাগত বৈচিত্র আল্লাহ তায়ালার কুদরত :

মাতৃভাষার বৈচিত্র আল্লাহ তায়ালার বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির একটি নিদর্শন।মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি জাতি স্বত্তা কে স্বাতন্ত্রতা দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা মাতৃভাষা দিয়েছেন।পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন।

ومن أياته خلق السموات والأرض واختلاف

السنتكم والوانكم-

অর্থাৎ: আর তার নিদর্শন সমুহের মধ্যে অন্যতম আসমানও জমিনের সৃষ্টি। তোমাদের বর্ণ এবং ভাষার মধ্যে পার্থক্য।(3) বিশ্বের মানচিত্রের বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক অবস্থান এবং বৈচিত্রময় সংস্কৃতির অন্যতম মূল উপাদান ভাষা। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, পৃথিবীর সর্বত্র যদি একই ভাষা হতো তাহলে এই নান্দনিকতার দৃশ্যপট কি আমরা পেতাম?

★ভাষা মানুষের সৃষ্টিগত অধিকার: মাতৃভাষা মানুষের সৃষ্টিগত অধিকার।আল্লাহ তায়ালা বানি আদম কে অপরাপর মাখলুক এর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের অন্যতম অনুষঙ্গ বা উপকরণ হলো মাতৃভাষা।হজরত আদম(আ) কে সৃষ্টি করে তাঁকে ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপনের আগে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন।পরক্ষণে ফিরিশতাদের সামনে যখন তিনি উপস্থাপিত হলেন, ফিরিশতারা তাঁর জ্ঞানের সম্ভার দেখে হতবিহবল হয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। পবিত্র কুরআনেও (4) ঠিক এই
ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

وعلم أدم الأسماء كلها ثم عرضهم على الملاءكة فقال انبءونني باسماء هولاء ان کنتم صدقين

মাতৃভাষা দ্বীন প্রচারের মাধ্যম: হিদায়াতের দাওয়াহ প্রচারের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালার স্ট্রেটেজি হলো, নিজ ভাষাভাষিদের হিদায়াতের জন্য নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসুল বা পথপ্রদর্শক নিযুক্ত করা। প্রত্যেক জাতির জন্য হিদায়াতের বাণী বা ওহী পাঠানোর ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সে জাতির ভাষাকেই প্রাধাণ্য দিয়েছেন। যেমন, তাওরাত নাযিল হয়েছে হিব্রু বা ইবরানি ভাষায়।মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান,

وما ارسلنا من رسولا الا بلسان قومه ليبين لهم –

অর্থাৎ: আর আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্ব-ভাষাভাষি রাসুলই প্রেরণ করেছি। যেনো, সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা দিতে পারেন। (5) আসমানী ওহী আসার ক্ষেত্রে যদি, বৈপরিত্ব বা বৈসাদৃশ্য দেখা যেত তাহলে, দা’ওয়াহ পরিপূর্ণ হতো না।

ولو جعلنه قرأنا أعجميا لقالوا لولا فصلت ايته

আর আমি যদি কুরআন কে অনারবদের ভাষায় অবতীর্ণ করতাম তারা (আরব) বলতো; যদি এর অয়াতগুলো সুস্পষ্ট বর্ণিত হতো।(6) “

মানুষের বিবেক, বুদ্ধি, নৈতিকতা কে উৎকর্ষ থেকে উৎকর্ষতর করার মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষা এবং ওহীর সমান্তরাল পথ চলাই আমাদের বুঝিয়ে দেয় ভাষাগত আগ্রাসন কখনো ইসলাম পছন্দ করে না।

★মাতৃভাষার ভালোবাসা নবীজি (দরূদ)র সুন্নাহ: কুল কায়েনাতের রাসুল,বিশ্বমানবতার
শিক্ষক রাসুলে পাক (দরুদ)’র প্রতিটি কাজই উম্মাহর জন্য শিক্ষনীয়। মাতৃভাষার প্রতি আমাদের নবির ভালোবাসা একটি দৃষ্টান্তমূলক এবং চোখে পড়ার মতো বিষয়। প্রিয় নবি (দরূদ) ইরশাদ করতেন,

أنا أعرب العرب ولدتني قريش

যার মর্মবাণী হলো- আমি কুরাইশ বংশে শুভগমনকারি নিখাদ আরবি।(7)

নবীজি নিজের ভাষা কে নিয়ে গর্ববোধ করতেন। যেমনিভাবে এসেছে (8)
احبو العرب لثلاث لاني عربي والقران عربي وكلام اهل الجنة عربي

“তোমরা তিনটি কারণে আরবি কে ভালোবাসো। নিশ্চয়ই আমি আরবি, কুরআন আরবি এবং জান্নাতীদের ভাষাও আরবি।

★আমাদের করণীয়: সম্মানিত পাঠক,এটি ফেব্রুয়ারি মাস।সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার শফিউর দের রক্তস্নাত,রাজপথ রঞ্জিত ভাষা আন্দোলের মাস।বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম ভাষা। প্রায় ২২ কোটির অধিক মানুষের কন্ঠে জড়িয়ে থাকা ভাষা।(9)
বর্বর, জালিম, হায়েনা পশ্চিম পাকিস্তানীরা যখন এদেশের মানুষের কণ্ঠরোধ করেছিলো, তখন, আপামর জনতা রাজপথে নেমে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ৫২ থেকেই ৭১ সালের ‘১৬ ডিসেম্বর’ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুধয়। স্বাধীনতার সেই স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠেছিল ১৯৫২ সালে। বড্ড পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা আমাদের মাতৃভাষা সম্পর্কে বড়ো বেয়ারা। নিজের ভাষায় কথা বলা কে আমরা পশ্চাৎপদতা এবং অজ্ঞতা মনে করি।মাতৃভাষা একটি অলংকার। যে অলংকার পরে নিজেকে সাজিয়েছেন, পারস্যের শেখ সাদী। উপমহাদেশের ইমাম আহমদ রেজা, ইকবাল এবং বাংলাদেশের নজরুল, ফররুখ, গোলাম মোস্তফা , আল- মাহমুদরা। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজের ভাষার গুরুত্বহীনতাই তোলে ধরছি। তাদের পশ্চীমা ধাঁচেই বড়ো করছি।যা আমাদের একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। কবি বলেছেন(10) “যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।। প্রিয় পাঠক, নিজের ভাষায় মা-ও-মা, আম্মু, অম্ব; বা, বাবা আব্বু বলে ডাকার মাঝে যে তৃপ্তি সেটা Mom, Mummy, Dad papa তে কষ্মিণকালেও পাওয়া যায় না।

লিখেছেন: ‘মুহাম্মদ আবদুল কাদের ছাকিব আল কাদেরী ‘
খতিবঃ পাঠানটুলী চাট্টশ্বরাই গায়েবী মসজিদ, আগ্রাবাদ,চট্টগ্রাম।
ওস্তাজ: তৈয়বীয়া তাহেরিয়া সুলতান মোস্তফা কমপ্লেক্স।

তথ্যসূত্র:

1/ আল কুরআন, সূরা আর রহমান, ৫৫:৩,৪
2/ Wikipedia.org//ethnolgue 2019
3/আল কুরআন, সূরা আল বাকারা- ৩০:২২
4/ আল কুরআন, সূরা আল বাকারা- ২:৩১
5/আল কুরআন, সূরা ইবরাহিম -১৪:০৪
6/আল কুরআন, সূরা ফুস্সিলাত- ৪১:৪৪
7/ আত-তাবরানী, মু’জাম- আল কাবীর, খ:০৬, পৃঃ ৩৫, হযরত আবু সাঈদ খুদ্বরী বর্ণিত।
8/ হাকেম,মুস্তাদরাক: হা. নং: ৭০৭৮, বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান: হা.নং:১৪৩৩
9/দ্যা ডেইলি স্টার,বাংলা, -১৮ ফেব.২০২০.
10/ কবি আবদুল হাকিম; বঙ্গবাণী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *