যাঁরা হাশরের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে

ডক্টর মুফতি মাওলানা বখতিয়ার উদ্দিন আলক্বাদেরী
মুফাস্সির, জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ اللهُ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِهِ يَوْمَ لاظِلَّ الْأَظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌ نَشَافِي عِبَادَةِ اللَّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقَ بِالْمَسْجِدِ إِذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُودَ إِلَيْهِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَ رَجُلٌ دَعَتُهُ اِمْرَأَةٌ ذَاتُ حَسَبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَ رَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَاخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنفِقُ يَمِينُهُ مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ – مِثْلُوة : صفحه ۶۸

অনুবাদ

হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ পাক তাঁর (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবেনা: ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, ২. ওই যুবক যে আল্লাহ’র ইবাদতে বেড়ে ওঠেছে (তাঁর যৌবনকাল আল্লাহ’র ইবাদতে কেটেছে), ৩. ওই ব্যক্তি যার অন্তর সারাক্ষণ মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকে একবার (নামায পড়ে) বের হয়ে পুনরায় প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। ৪. ওই দু’ব্যক্তি, যারা একমাত্র আল্লাহ’র ওয়াস্তে একে অপরকে ভালবাসে। তারা আল্লাহ’র সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই পরস্পর একত্রিত হয় আর (আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্যেই পরস্পর) বিচ্ছিন্ন হয়। ৫. ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তখন তাঁর চক্ষুযুগল অশ্রুসজল হয়ে যায়। ৬. ওই ব্যক্তি যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী রমনী আহ্বান করে আর সে বলে, “আমি আল্লাহকে ভয় করি”। এবং ৭. ওই ব্যক্তি, যে এমনভাবে গোপনে আল্লাহ’র রাস্তায় দান করে যে, তার বাম হাত জানলনা তার ডান হাত কী দান করল।

।বুখারী ও মুসলিম শরীফ; মিশকাত: ৬৮ পৃষ্ঠা।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

একটি সুস্থ সমাজ ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র সবারই কাম্য। একজন রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সমাজপতি যতক্ষণ ন্যায়-নীতিবান হবে না, ততক্ষণ সেক্ষেত্রে কোন ধরনের কল্যাণ আশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। যুব সমাজের নৈতিক ও চারিত্রিক
অবক্ষয়ের কারণে আজকের বিশ্ব জর্জরিত, কলুষিত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কেন্দ্র হতে শুরু করে রান্নাঘর পর্যন্ত যখন দুর্নীতি, অবাধ্যতা আর অবিচারের কলুষতায় ছেয়ে যায় তখন মুক্তির আশা করা বৃথা বৈ-কি! অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় প্রতিটি নাগরিক কোন না কোনভাবে। আজকের বিশ্বে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, কোথাও কেউ সুখে নেই। এক ধরনের অপ্রাপ্তি আর অস্থিরতা ঝেঁকে বসেছে সবার মস্তিস্কে।

আর তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাদের জীবনীশক্তি। তাইতো সবাই হন্যে হয়ে ছুটছে সেই প্রশান্তির অন্বেষণে, মন্ত্র-তন্ত্রের পাতায় পাতায় চষে বেড়াচ্ছে; কিন্তু এতটুকু শান্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ, শান্তির নীড় আমাদের ঘরে।

আমরা মুসলমান বিশ্বে শ্রেষ্ঠজাতি। বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা হলেন আমাদেরই প্রিয় নবী। ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্র পর্যন্ত তিনি মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গনের সকল প্রকার সমস্যার সমাধান এবং পথচলার দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন আমাদেরকে অত্যন্ত সুনিপূণভাবে।

আলোচ্য হাদীস শরীফ ওই ধরনের একটি গাইডলাইন। হাদীস শরীফে উল্লিখিত সাতটি গুণে গুণান্বিত হয়ে মানুষ তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারে, তাহলে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র সব ক’টি হয়ে ওঠবে উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও সুস্থ।

প্রথমতঃ একজন রাষ্ট্রপ্রধান যদি ন্যায়পরায়ণ হন তাহলে ওই রাষ্ট্রে কোন অবস্থাতেই দুর্নীতি থাকতে পারে না, চলতে পারেনা কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি আর অবিচার। কর্মচারী, কর্মকর্তা ইত্যাদির মন-মানসিকতায় আসবে বিরাট পরিবর্তন। ফাঁকিবাজির কোন অবকাশ থাকবে না। ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারা হবে দ্রুত গতিশীল। মূলত: একজন সুশাসক চাইলে তার দক্ষ পরিচালনা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কবির ভাষায়-

যুগ যামানা পাল্টে দিতে চাইনা অনেক জন

শুধু একটি মানুষ আনতে পারে জাতির জাগরণ।

অবশ্য তাকে হতে হবে মুত্তাক্বী তথা খোদাভীরু। পবিত্র কোরআনে এরশাদ CCE-اِعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقُوى অর্থাৎ “তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা কর, কারণ এটাই তাক্বওয়ার নিকটতম পন্থা।”

পবিত্র হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-

الا كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সেই দায়িত্বের জবাবদিহি তাকেই করতে হবে।” [বুখারী।

সুতরাং, বাদশা বা শাসক যদি ন্যায়পরায়ণ হন তাহলে তার সর্বোচ্চ পুরস্কারপারলৌকিক শান্তি তথা বেহেস্ত এবং হাশরের ময়দানের প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যেদিন মানুষ দিক-বিদিক ছোটাছুটি করবে সেদিন কোন ধরনের ছায়া থাকবে না একমাত্র মহান আল্লাহ’র আরশের ছায়া ব্যতীত। সেদিন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ওই ছায়ায় আশ্রয় পাবেন। এভাবে নবী করীম আরো যারা আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন ধারাবাহিকভাবে তাঁদের নাম ঘোষণা দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত: ওই যুবক, আল্লাহ’র ইবাদতের মাধ্যমে যার যৌবনকাল কেটেছে। আমরা জানি মানুষের জীবনে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ সময় হচ্ছে যৌবনকাল। বিভ্রান্তির বেড়াজালে আক্রান্ত হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে এ সময়টাতে। ইবলীস-শয়তানও ওঠেপড়ে লেগে থাকে তাকে পথচ্যুত করার জন্য। সবদিক বিবেচনায় একজন যুবক নিজের রিপুকে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করে সফলতার পানে এগিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। এমনকি হাদীস শরীফে একে বড় জিহাদ বলা হয়েছে। সুতরাং, যৌবনকালের ইবাদত মহান আল্লাহ’র নিকট বেশি পছন্দনীয়। তাই তাদের পুরস্কার স্বরূপ হাশরের ময়দানে আরশের ছায়ায় তাদেরকেও শামিল করা হবে।

তৃতীয়তঃ ওই ব্যক্তি যার অন্তর সারাক্ষণ মসজিদের পানে লেগে থাকে। হাদীস শরীফের ভাষায় মহান আল্লাহ’র কাছে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল মসজিদ আর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জায়গা হল বাজার। হাট-বাজারে বর্তমানে নানা ধরনের আড্ডা এবং যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের বিভিন্ন উৎস রয়েছে। পক্ষান্তরে সে আশঙ্কাময় স্থান থেকে বিমুখ হয়ে যখন যুবসমাজ মসজিদমুখী হয়ে ওঠে তখন তাদের মন মানসিকতাও খোদাভীরুতায় ভরপুর হয়ে যায়। অধিকন্তু মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মানুষকে নিয়মতান্ত্রিকতা শিক্ষা দেয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়কারী নিষ্পাপ শিশুর মত দিনাতিপাত করে থাকেন। মিথ্যা, জুলুম, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতারণা ইত্যাদি অপকর্ম তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ফলে সমাজে ফিরে আসে শান্তির পরিবেশ।

চতুর্থতঃ মানুষ সামাজিক জীব। তাই একাকী সে বসবাস করতে পারে না। সমাজে চলতে গেলেই প্রয়োজন হয় বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালবাসা ইত্যাদি। সমাজের মানুষ একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করলে তারা এগিয়ে যেতে পারে অনেক দূরে- যদি না তাদের সেই প্রীতির অভ্যন্তরে জাগতিক উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে। কারণ যেখানে কৃত্রিমতা থাকে সেখানে চূড়ান্ত সফলতা আসতে পারেনা। ইসলাম অকৃত্রিম ভালবাসার শিক্ষা দিয়েছে। একমাত্র আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই একে অপরকে ভালবাসলে তাদের জন্য রয়েছে পরকালের ওই পুরস্কার।

পঞ্চমতঃ আমাদের সবার স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তিনিই আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদির ব্যাপারে ভাল জানেন এবং কোথায় আমাদের জন্য সুখ-শান্তি রয়েছে কোন পথে চললে শান্তি পাওয়া যাবে সেটা তিনিই একমাত্র ভাল জানেন। আজকের বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে জিজ্ঞেস করা হলে জানা যাবে, সবাই কম-বেশি অশান্তির আগুনে পুড়ছে। সেই অশান্তির লেলিহান শিখা হতে মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা সবারই। আর সেটা পূরণের জন্য একটি মূল-উপায় স্বয়ং রব্বুল আলামীন শিখিয়ে দিয়েছেন। আর তা হল- আল্লাহ’র যিকর। যেমন এরশাদ হচ্ছে- أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُ الْقُلُوبُ অর্থাৎ “শোনে! আল্লাহ’র যিকর’র মাধ্যমেই অন্তরের প্রশান্তি অর্জিত হয়।”

ষষ্ঠতঃ পবিত্র ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আর তার শাস্তির বিধানও করা হয়েছে কঠোরভাবে। আর ওই ধরনের নিশ্চিত মহাপাপ থেকে ফিরে আসা সত্যিকারের ঈমানদারের পরিচায়ক। একমাত্র খোদাভীতির কারণেই বান্দা ব্যভিচার হতে দূরে সরে আসতে পারে। তাই তার পুরস্কার হিসেবে হাশরের ময়দানে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দান করা হবে।

সপ্তমতঃ দানশীল ব্যক্তি আল্লাহ’র প্রিয় বান্দা। তবে ওই দান হতে হবে নিরেট তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনার্থে। লোক দেখানো কিংবা লোকে দানশীল বলুক সে উদ্দেশ্যে যদি দান করা হয় তাহলে তা আল্লাহ’র দরবারে কবুল হবেনা। এরশাদ হচ্ছে-

إِنَّ اللَّهَ لَا يَنظُرُ إِلَى صُورِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَنِيَّاتِكُمُ

অর্থাৎ, “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আকৃতি ও ধন-সম্পত্তির দিকে দেখেননা বরং তোমাদের অন্তর ও উদ্দেশ্যের দিকেই দেখেন।” তাই দান-খয়রাত করতে হবে যতটুকু সম্ভব গোপনে গোপনে। আর এই ধরনের ব্যক্তিদেরকে হাশরের ময়দানে আল্লাহ’র আরশের নিচে আশ্রয় দান করা হবে।

পরিশেষে, বলতে হয়, হাদীস শরীফে বর্ণিত সাত প্রকারের মানুষ নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। এরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী করার ক্ষেত্রে মহান ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে আর পরকালেও তাঁরা সফল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *