আল্লাহ নিরাকার

সৈয়দ মোহাম্মদ শরফুদ্দীন সম্রাট

(প্রথব পর্ব)

ভূমিকা: আল্লাহ তাবারিক ওয়াতায়ালা এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি, তিনি সমস্ত বিশ্বজাহান সৃষ্টি করেছেন।অতঃপর মানুষ এবং জ্বীনকে তাঁর ইবাদতের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে,বিশ্বের সৃষ্টিকূল মহান আল্লাহর প্রতি সিজদা আরয বা অনুগত।যে যার ভাষায় আল্লাহ পাকের মহত্ত্ব,গুণাগুণ প্রকাশ করে এবং ঘোষণা করে।
সমস্ত সৃষ্টিকূলের মাঝে মানুষকে আল্লাহ পাক ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

কেননা,মানুষ সমগ্র সৃষ্টিকূলের মাঝে আল্লাহ তায়ালার তাওহীদ বা একত্ববাদের প্রচারকারী।
তাই আল্লাহ পাক নবী-রাসূল,সাহাবী,আউলিয়া কেরামগণকে প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ পাক মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন।তবে আল্লাহর জাত ও সিফাত এবং মারেফত সম্পর্কে জানতে ও জানাতে আল্লাহ মানুষের মাঝে যাকে ইচ্ছা তাকে ‘ডিভাইন নলেজ’ বা ‘ঐশ্বরিক জ্ঞান’ দান করেছেন যাকে আরবি পরিভাষায় ‘ইলম বা হিকমাহ’ (প্রাজ্ঞতা) বলা হয়।
সুতরাং,আল্লাহ তায়ালার হাকিকত,মারেফত,অস্তিত্ব,জাত ও সিফাত সম্পর্কে জানতে সেসমস্ত মনিষী বা আহলে ইলম (জ্ঞানবান) ব্যক্তিদের লেখনিসমূহ,বক্তব্য বা মজলিস সমূহ আমাদের চলার পথের পাথেয়।যা আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করে সাথে আমাদের অন্তর হতে সন্দেহ নিরাময় করে।

নিম্নে উপরিউক্ত বিষয়টি আলোচিত হলো-

আল্লাহ তায়ালা নিরাকার-এর ব্যাখ্যা: আল্লাহ جل شانہ পবিত্র কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন-
❝আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।❞

❝অতঃপর আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন।❞

❝অতএব,তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান।❞

উপরিউক্ত প্রত্যেকটি আয়াতের হাকিকী এবং মাযাজি (রূপক) অর্থ রয়েছে।এসমস্ত আয়াতের হাকিকী,মাযাজি অর্থ,তাবিল বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে কেবল আহলে ইলম এবং الراسخون فى العلم (কুরআন ও হাদিসে যথোপযুক্ত পাণ্ডিত্য অর্জনকারী) ও মহান হাস্তী বা জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অবগত রয়েছেন।
উল্লিখিত আয়াতে কোনটি মুহকামাত (মজবুত) কোনটি মুতাশাবিহাত (রূপক) তা সম্পর্কে আমরা অবগত নই।কুরআন মাজীদে মুহকামাত ও মুতাশাবিহাত আয়াতসমূহ রয়েছে।এ সমস্ত আয়াতের হাকিকী ও মাযাজি (রূপক) অর্থ এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে হলে আহলে ইলম বা কুরআন,হাদিস,ফিকহ,ফাতওয়া এর উপর বুৎপত্তি অর্জনকারী ব্যক্তিদের সুচিন্তিত মত বা ভাষ্যের সন্দেহাতীত অনুসরণ করতে হবে।নাহয় আমরা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যাবো।
কুরআন-হাদিস,ইজমা,কিয়াসে যাঁরা গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁদের তাত্ত্বিক ভাষ্য ও লেখনী সমূহকে অনুসরণ করতে আল্লাহ পাক আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-

فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ.

অর্থাৎ,❝তোমরা যদি না জানো তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।❞ [সূরা আন-নাহল,আয়াত: ৪৩]

বর্ণিত আয়াতসমূহের সরাসরি সরল অনুবাদ দেখে কোনরূপ গবেষণা ও পর্যালোচনা ছাড়া আল্লাহর আকার বা আকৃতি সাব্যস্ত করা সহীহ বা শুদ্ধ হবে না।
এক্ষেত্রে আমাদের আহলে ইলমগণের লেখনী ও বক্তব্যসমূহের অনুসরণ করতে হবে।

কুরআন মাজীদের আয়াত ও এর তাফসীর:

  • قال الله تعالى: ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ.

অর্থাৎ,অতঃপর (আল্লাহ তায়ালা) আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন। [সূরা আরাফ,আয়াত: ৫৪]

উক্ত আয়াতের তাফসীর:

“ষষ্ঠ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি শাফেয়ী (রা:) বলেন-
ثم استوى على العرش من المتشابهات التي يجب تأويلها. فثبت بمجموع هذه الدلائل العقلية و النقلية أنه لا يمكن حمل قوله ( ثم استوى على العرش) على الجلوس والاستقرار و شغل المكان والحيز۔
أن نقطع بكونه تعالى متعاليا عن المكان والجهة ولا نخوض في تأويل الاية على التفصيل بل نفوض علمها إلى الله۔
فكذا هاهنا يذكر الاستواء على العرش والمراد نفاذ القدرة وجريان المشيئة۔

আয়াতটি মুতাশাবিহাত এর অন্তর্ভুক্ত।যার তাবিল বা ব্যাখ্যা অপরিহার্য।দলিলে আকলি ও দলিলে নকলী হতে প্রমাণিত যে,
আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর বসেছেন,স্থির হয়েছেন,স্থানের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন-উক্ত আয়াতের অর্থকে আল্লাহর শানে এভাবে কল্পনা করা অসম্ভব।বরং এই আয়াতের সঠিক জ্ঞান আল্লাহর দিকে সোপর্দ করতে হবে।যেহেতু আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পূতপবিত্র।
❝আরশের উপর সমাসীন❞ থেকে উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় কুদরত ও ইচ্ছা কার্যকর করা। [1]

আল্লামা ইসমাইল হাক্বী বুরসেভী হানাফি (রা:) বলেন-

فجعل الاستواء على العرش كناية عن نفس الملك والعز والسلطنة۔ونفذ قدرته في مصنوعاته وتخصيص العرش؛ لأنه أعظم المخلوقات۔
قال شيخي العلامة أبقاه الله بالسلامة: المراد بهذا الاستواء استواؤه سبحانه، لكن لا باعتبار نفسه و ذاته تعالى علوا كبيرا عما يقول الظالمون بل باعتبار أمره الإيجادي وتجليه التجلي الأحدي المعبر عنه في القران بالحق۔

উক্ত আয়াতে ❝আরশের উপর সমাসীন❞ এটি হতে রূপক বা ইঙ্গিতপূর্ণ অর্থ গ্রহণ করতে হবে।অর্থাৎ,আরশের উপর তাঁর বাদশাহী ও সালতানাত কার্যকর হয়েছে।বিশেষভাবে,উক্ত আয়াতে আরশকে সকল সৃষ্টির মহান সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমার শায়েখ বলেন,❝এখানে সমাসীন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো-আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব অবস্থান,তবে তা তাঁর সত্ত্বাগত বিবেচনা করে নয়।যা জালেমরা বলে,আল্লাহ তার চেয়ে অনেক মহান।বরং,এটি তাঁর সৃষ্টির আদেশ এবং তাঁর একত্বের প্রকাশ।যেটিকে কুরআনে হক শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।❞ [2]

হিজরি নবম শতকের সমসাময়িক একজন মুজাদ্দিদ ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতী শাফেয়ী (রা:) এর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে-

عن أم سلمة أم المؤمنين رضي الله عنها في قوله ( ثم استوى على العرش) قالت: الكيف غير معقول،والاستواء غير مجهول، والاقرار به ايمان ، والجحود به كفر۔

উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা:) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,❝আরশের উপর সমাসীন হওয়া মানুষের আকল বা বিবেকের বহির্ভূত।তবে উক্ত আয়াতের উপর ঈমান রাখতে হবে।অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে।তার ব্যাখ্যা মানুষের জানার বিষয় নয়।❞[3]

দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফি আল-মাতুরিদি (রা:) বলেন,

وجمع السلف و جمع من الخلف على أن استواء العرش صفة الله بلا كيفية نؤمن بها ونكل علمها الى عالمها۔

❝সকল পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইমামগণ এ কথার উপর ঐক্যমত পোষণ করে বলেন যে,আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর সমাসীন হওয়াটা আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ।যেটি কোন প্রকারের রকম ছাড়া।এটির উপর আমরা ঈমান এনেছি এবং তার জ্ঞানকে তার নিজস্ব জগতের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। (আল্লাহর আরশের সমাসীন বা অবস্থান আমাদের জ্ঞানের বাহিরে,এর কাইফিয়ত বা ধরণ আমাদের জানার বাহিরে)। [4]

হযরত শায়েখ আব্দুল কাদের জিলানী (রা:) বলেন,

أي على عروش المظاهر و المكونات الكائنة والأقطار ،منزها عن الجهات والاستواء و الاستقرار والتمكن مطلقا۔

❝আল্লাহ তায়ালা আরশ আজীমের উপর স্বীয় শান অনুযায়ী জালওয়া আফরোজ (আরশকে সম্মানিত করেছেন) হয়েছেন।যা কোনো প্রকারের দিক এবং মানুষের ন্যায় সমাসীন হওয়া থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।❞[5]

ইমাম আযম আবু হানিফা (রা:) ❝আরশের উপর সমাসীন❞ এর ব্যাখ্যায় বলেন-

نقر بأن الله تعالى استوى على العرش من غير أن يكون له حاجة واستقر عليه وهو حافظ العرش۔

❝আল্লাহ আরশের দিকে মুখাপেক্ষী নন।আরশের উপর স্থির অর্থ হলো-তিনি আরশের সংরক্ষক।❞[6]

উপসংহার: আল্লাহ তায়ালা অসীম।তাই তাঁর জাত-সিফাতের হাকিকত আমাদের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার উর্ধ্বে।সৃষ্টিজীবের মত আল্লাহ পাককে নির্ধারিত আকার-আকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা অজ্ঞতার শামিল।যা ইতোপূর্বে মুফাসসিরকূল শিরোমণি এবং সালফে-সালেহীনদের সারগর্ভ লেখনী সমূহ হতে জানা গেছে।আল্লাহ পাক আমাদের সঠিক বুঝ ও বোধশক্তি দান করুন-আমিন!

সূত্র-

[1] তাফসীরে কবির,১৩-১৪ খন্ড,(পৃষ্ঠা-১০৬,১০৭)।
[2] তাফসীরে রুহুল বায়ান,৩য় খন্ড,(পৃষ্ঠা-১৮৫)।
[3] তাফসীরে দুররুল মানসুর,৩য় খন্ড,(পৃষ্ঠা-১৭০)।
[4] তাফসীরে মোল্লা আলী কারী (রা:),২য় খন্ড,(পৃষ্ঠা-১৩৫)।
[5] তাফসীরে জিলানী,২য় খন্ড,(পৃষ্ঠা-১১১)।
[6] ওয়াসীয়্যাতুল ইমামে আবি হানিফা (রা:),(পৃষ্ঠা-৩৮)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *